ইতিহাস ডেস্ক: ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী দুই অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ স্বীকৃতি দিয়েছে মস্কো। অথচ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভকারী দেশগুলোয় পশ্চিমা শক্তির প্রভাব রুখতে অতীতেও সামরিক অভিযান চালিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন তারই সর্বশেষ উদাহরণ। এভাবে রাশিয়া নিজের কৌশলগত গুরুত্বও বাড়াতে চাইছে।
সবশেষ সামরিক আগ্রাসনের ঘটনাকে একবিংশ শতকে রাশিয়ার অন্যান্য সামরিক অভিযানের সাথে তুলনামূলক আলোচনা করছেন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের কোনো পরিকল্পনা নেই – প্রায় দুই মাস ব্যাপী এমন কথাই জানায় মস্কো। তারপর গেল মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চল দনেয়স্ক ও লুহানস্কে ‘শান্তিরক্ষী’ হিসাবে রুশ সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীরা এই দুটি অঞ্চল কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে লড়ছে। তারা চায় স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। তবে এই স্বাধীনতার আড়ালে রয়েছে রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল দুটির মস্কোর অনুগত থাকার ইচ্ছা।
সেনা মোতায়েন এবার রূপ নিয়েছে পুরোদস্তুর আগ্রাসনে।
ইউক্রেন সংকটের কিছু স্বতন্ত্রতা থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনের সিদ্ধান্ত রাশিয়ার সাম্প্রতিক অতীতের সামরিক অভিযানের বৈশিষ্ট্যের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। যেগুলোর মূল লক্ষ্যই ছিল, তুলনামূলক দুর্বল প্রতিবেশীদের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে আয়ত্তে রাখা এবং তাদের পশ্চিমামুখী হওয়া বন্ধ করা। এ প্রক্রিয়ায় ন্যাটো সামরিক জোটেরও পূবমুখী সম্প্রসারণ ব্যাহত করতে চায় ক্রেমলিন।
যেসব সাবেক সোভিয়েত দেশ পশ্চিমামুখী হওয়ায় আগ্রহ দেখিয়েছে- সেখানে স্থায়ী সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা জিইয়ে রাখে ক্রেমলিন, যাকে বলা হচ্ছে- ‘ফ্রোজেন কনফ্লিক্ট’। যেমন গত তিন দশকে মলদোভার ট্রানসিত্রিয়া অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিয়েছে রাশিয়া। অঞ্চলটি মলদোভা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাও করেছে। বিদ্রোহী বাহিনীর ছদ্মবেশে সেখানে আসলে লড়েছে রুশ সেনারাই। যেমনটা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলেও ঘটেছে।
২০০৮ সালে জর্জিয়া থেকে স্বাধীনতাকামী দুটি অঞ্চল: দক্ষিণ ওশেটিয়া ও আবখাজিয়ার বিদ্রোহী সরকারের সমর্থনে সামরিক আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। ওই দুটি অঞ্চলে ছিল বড় সংখ্যায় রুশভাষী জনতা। এ ঘটনার ছয় বছর পর ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে রাশিয়া। মস্কো তখন থেকেই দেশটির ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের সরাসরি সহায়তা দান শুরু করে।
প্রতিটি ঘটনায় প্রতিবেশী সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই সামরিক পদক্ষেপ নেয় মস্কো। এসব অঞ্চলে নৃতাত্ত্বিক রুশ জনসংখ্যার উপস্থিতি এবং তাদের সুরক্ষা দেওয়ার যুক্তিকে রণযাত্রার অজুহাত হিসাবে দেখায় ক্রেমলিন।
ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন স্বীকৃতি দানকালে দেওয়া ভাষণে পুতিন- সেই একই যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, পূর্ব ইউক্রেনে রুশভাষী জনগোষ্ঠী ‘গণহত্যার’ শিকার হচ্ছে।
যুদ্ধ বাঁধানোর গৎবাঁধা কৌশলপত্র:
২০২১ সালের অক্টোবর থেকেই ক্রিমিয়া, পূর্ব ইউক্রেন সীমান্ত ও বেলারুশে সেনা উপস্থিতি বাড়ায় রাশিয়া। ডিসেম্বর নাগাদ ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা সমাবেশ বিশালাকার ধারণ করে। সমবেত করা হয় পর্যাপ্ত সংখ্যায় সাঁজোয়া যান, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার গানশিপ, গোলন্দাজ ইউনিট ইত্যাদি। এত বড় সামরিক শক্তি পুতিন কী করবেন তা নিয়ে তখন নিশ্চিত ছিল না বিশ্ব। তবে শেষপর্যন্ত সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জর্জিয়ার মতো করেই প্রচলিত সামরিক আগ্রাসনের পথ বেঁছে নিলেন পুতিন।
২০০৮ সালে বেইজিংয়ে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক চলাকালে জর্জিয়ায় আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। সে সময়ে চীনা কর্মকর্তারা এতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এবার চীনকে তুষ্ট রাখতেই হয়তো শীতকালীন অলিম্পিক সমাপনী অনুষ্ঠান পর্যন্ত দেরি করেছেন পুতিন।
পুতিনের এই ছকবাধা কৌশল দেখে জর্জিয়াবাসী বিস্মিত হননি। বর্তমান ঘটনাবলী তাদের কাছে অতীতেরই পুনরাবৃত্তি। যে অতীতে রাশিয়ার কাছে পরাজয়ের দগদগে ঘা এখনো আমাদের জাতীয় জীবন থেকে মুছে যায়নি। মন্তব্যটি করেন, জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এমিল আভদালিয়ানি। তিনি দেশটির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জিওকেস- এরও সম্মানীয় ফেলো।
এমিল বলেছেন, “ডনবাসের দুটি বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলকে রাশিয়া স্বীকৃতি দেবে তা জর্জিয়ার বেশিরভাগ মানুষই অনুমান করতে পেরেছিল। গত এক বছরে এনিয়ে সব সন্দেহের অবসানও হতে থাকে। এ সময়ে মস্কো অঞ্চল দুটির বিদ্রোহী কর্তৃপক্ষকে দেওয়া সহায়তা বৃদ্ধি করে। ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের রুশ পাসপোর্ট দেওয়া হয়, এমনকি গোপনে বাড়তে থাকে রুশ সেনাদের উপস্থিতি। পুতিনের সিদ্ধান্ত ছিল এই প্রক্রিয়ার যৌক্তিক উপসংহার।”
তার পর্যবেক্ষণ, “গৎবাধা কৌশলপত্র অনুসারেই আগ্রাসনের পদক্ষেপ নিয়েছে মস্কো। তার আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করে প্রতিবেশী ইউক্রেন যাতে পশ্চিমা কোনো অর্থনৈতিক বা সামরিক জোটে না যোগ দেয়- সে চাপ সৃষ্টি করা হয়।”
রাশিয়ার নিকট অঞ্চলের সুরক্ষা!
জার আমলে রুশ সাম্রাজ্যের বিদ্রোহী অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হতো। এরপর তাদের ভূমিতে পাঠানো হয় রুশভাষী বসতি স্থাপনকারীদের। এভাবে জনসংখ্যা অনুপাতে রদবদল আনার ঘটনা সোভিয়েত আমলেও অব্যাহত ছিল। তবে এসব পদক্ষেপই বুনে দেয় সংঘাতের আদি বীজ। মূল অধিবাসীরা কখনোই রুশভাষীদের মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় কারণে রুশভাষীরাও রাশিয়ার অনুগত থাকতে চায়। আর নিকট প্রতিবেশী দেশে রুশভাষীদের নিরাপত্তা দানকেই ন্যায্য অধিকার বলে দাবি করে মস্কো।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ার সমরকৌশল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ নিকোলো ফাসোলা বলেন, “রাশিয়া নিজেকে তার ঐতিহাসিক প্রভাব বলয়ে একমাত্র সার্বভৌম শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। তাই সেখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ সে হতে দেয় না।”
তার মতে, “ঘরের কাছে বিদেশি শক্তির অনুপ্রবেশ নিয়ে রাশিয়া সব সময়েই উদ্বেগে থাকে। এই উদ্বেগ শুধু সামরিক বা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার নয়, বরং সাংস্কৃতিকও।”
২০০৩ সালে জর্জিয়া এবং ২০০৪ সালে ইউক্রেনে তথাকথিত ‘কালার রেভ্যুলেশনে’র মাধ্যমে পশ্চিমাপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার কথা উল্লেখ করে নিকোলো বলেন, রাশিয়া তখন ভেবেছে পশ্চিমা দেশগুলোর মদদপুষ্ট শক্তি দেশ দুটি থেকে রাশিয়ার প্রভাবকে দূর করেছে। ঠিক একারণেই মলদোভা থেকে বিচ্ছিন্ন অঞ্চল ট্রানসিত্রিয়ায় রুশ সেনারা রয়ে গেছে। ১৯৯০ এর দশকে রোমানিয় ভাষা আরোপের সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করে এই অঞ্চলের রুশভাষী জনতা। পরবর্তীকালে নৃতাত্ত্বিক রুশদের রক্ষার সেই যুক্তিতেই সামরিক অভিযানের সাফাই দেন পুতিন।
মার্কিন সেনাবাহিনীর ওয়ার কলেজ পাক্ষিক ম্যাগাজিনে বিশেষজ্ঞ এরিক জে. গ্রোসম্যান লিখেছেন, “রাশিয়া ট্রানসিত্রিয়াকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি না দিলেও, মস্কোর হস্তক্ষেপ দেশটির স্বার্বভৌমত্ব দুর্বল করে গত ২৫ বছর ধরে পশ্চিমাদের সাথে জোট বাধার প্রক্রিয়া থমকে দিয়েছে।”
তবে সামরিক আগ্রাসনের কারণে দিনে দিনে প্রতিবেশী দেশে রাশিয়া বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে। পুতিনের হামলা চালানোর সিদ্ধান্তে ইউক্রেনে রাশিয়া-বিরোধী জনমত এখন দৃঢ় ভিত্তি লাভ করলো। সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোও বিপদগ্রস্ত ইউক্রেনের প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ফলে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা এতে হুমকির মুখেই থাকবে।
আভদালিয়ানি বলেন, “রাশিয়া হয়তো স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যপূরণ করতে পেরেছে, কিন্তু হারিয়েছে তার কোমল শক্তির মর্যাদা। ভূ-রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া নির্ভর হওয়ার কথা এখন ইউক্রেন বা জর্জিয়ায় কম মানুষই ভাবতে পারবে। আমি মনে করি, দূর ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যায় রাশিয়া তার এমন সব সুবিধা হেলায় হারিয়েছে।”
সূত্র: ফ্রান্স ২৪
আপনার মতামত লিখুন :