নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা নাটকীয়তার পর রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই হচ্ছে বিএনপির মহাসমাবেশ। সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে আজ এ কর্মসূচি পালন করছে দলটি। রাজপথ নিয়ন্ত্রণে নিতে এ সমাবেশে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। সারা দেশের ইউনিয়ন থেকে জেলা-সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখন ঢাকায়। রাজধানীকে সমাবেশের নগরী করতে চায় দলটি।
দুপুর ২টায় শুরু হবে শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচি। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হবে নতুন কর্মসূচি। ঢাকা ঘিরেই তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে একই দিনে সভা-সমাবেশের বিষয়টি আছে আলোচনার শীর্ষে। নতুন কর্মসূচি ঘোষণার আগে দাবি মেনে নিতে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলেও আলোচনা আছে।
আজকের মহাসমাবেশকে সরকার পদত্যাগের চূড়ান্ত আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সমাবেশে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে পালটে যেতে পারে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি।
তাৎক্ষণিকভাবে রাজপথে টানা অবস্থানসহ কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। তাই যে কোনো অবস্থা মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশে অংশ নিতে বলা হয়েছে। কর্মসূচি পালনে সার্বিক সহযোগিতা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলের নেতারা।
যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সমমনা ৩৭টি রাজনৈতিক দল অভিন্ন দাবিতে রাজধানীর ১১ স্থানে মহাসমাবেশ করবে। তবে এক সময়ের জোটসঙ্গী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চলমান যুগপৎ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও বিএনপির মহাসমাবেশের প্রতি সমর্থন রয়েছে দলটির।
২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তারুণ্যের সমাবেশ থেকে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। সে অনুযায়ী দ্বিতীয়বারের মতো নয়াপল্টন বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কর্মসূচি পালনের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) কাছে আবেদন করে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, ২৩ শর্তে বিএনপিকে মহাসমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অনুমতি পাওয়ার পরপরই পালটে যায় নয়াপল্টন ও আশপাশের চিত্র। সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আসতে থাকেন। সন্ধ্যার পর কার্যালয়ের সামনের সড়ক ও অলিগলি নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে । বিকাল থেকেই শুরু হয় সড়কে মাইক লাগানো।
বিকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বিলম্বে হলেও নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ায় পুলিশকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, মহাসমাবেশ সফলে ইতোমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনায় শান্তিপূর্ণ এই মহাসমাবেশে দলে দলে যোগ দেবেন।’
কয়েক মাস ধরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কর্মসূচি সহিংসতার দিকে যায়নি উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, অনুমতি নিয়ে কয়েক দিন নাটক তামাশা স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করে দিল সরকার। একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই, বিএনপি কখনো অশান্তি হয়, এমন কর্মসূচি পালন করে না।
উলটো গুলি হামলা করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। গত দুদিনে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো উসকানিতে পা দিইনি। একইদিনে পালটা কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানান মির্জা আব্বাস।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আটককৃত সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দিন। আপনারা নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ সহযোগিতা করবেন।
এ সময় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি সহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। সরকার সুযোগ খুঁজছে যাতে সংঘাত সৃষ্টি হয়। আমরা ফাঁদে পা দেব না। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনের সড়ক ছেড়ে দিতে নেতাকর্মীদের ১০ মিনিট সময় দেয় পুলিশ। এর ৫ মিনিটের মধ্যেই স্লোগান বন্ধ করে সড়ক ছেড়ে দেন নেতাকর্মীরা।
এরপর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এসে কার্যালয়ের সামনের ফুটপাত থেকেও নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেন। একপর্যায়ে নয়াপল্টনে গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া আর কাউকেই অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। বেলা ৩টার দিকেও কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। বিকালে অনুমতি পাওয়ার পর কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যরা সরে সড়কের এক পাশে অবস্থান নেন।
নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে আসতে থাকেন। এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি কার্যালয়ের সামনে থাকা নেতাকর্মীদের সরিয়ে সড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক করতে বলেন।
বৃহস্পতিবার মহাসমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। রাতে নয়াপল্টনের বিভিন্ন হোটেল ও রাজধানীর অনেক এলাকায় শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত গণগ্রেফতারের ঘটনা ঘটেনি।
পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি বিএনপির। কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, সারা দেশে থেকে আসা নেতাকর্মীরা সমাবেশের কোন জায়গায় অবস্থান নেবেন তা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের জন্যও স্থান নির্ধারণ থাকবে। ঢাকা মহানগরের প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মীকে অংশ নিতে বলা হয়েছে। তারা সে প্রস্তুতিও নিয়েছেন।
বিশেষ করে রাজধানীর আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলা ও মহানগর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলা থেকে ব্যাপক উপস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নেতারা জানান, এ মহাসমাবেশ হবে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়।
এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাত ১০টার দিকে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মঞ্চ তৈরি করার জন্য বাঁশ আনা হয়। রাত সাড়ে ৯টার পরে কার্যালয়ের সামনে আটটি ট্রাক আসে। এসব ট্রাকের ওপরেই মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে।
এদিকে ঢাকার মহাসমাবেশ উপলক্ষ্যে সারাদেশ থেকে আগত নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার না করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপিকে অনুরোধ করেছে বিএনপি। রাতে বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ডিএমপি কমিশনারকে ফোন করে এ অনুরোধ জানান। এ্যানি যুগান্তরকে বলেন, ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, গণগ্রেফতার করা হবে না। যাদের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, মেস ও বাসা-বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে তাদের বিষয়েও খতিয়ে দেখবেন।
ডিএমপি কমিশনারের প্রতি একই আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছে একটি লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের নেতৃত্বে আইনজীবীদের ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল ডিএমপি কমিশনার কার্যালয়ে গিয়ে এই আবেদন জমা দেন।
এছাড়া সেখানে উপস্থিত নেতাকর্মীদের জন্য রাতে ট্রাকে করে প্যাকেট খাবার আনা হয়। ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণের উদ্যোগে এ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।