ইতিহাস প্রতিদিন ডেস্ক : আজরাবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ-২৯) শেষ হয়েছে রোববার। সম্মেলনে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দরিদ্র দেশগুলো যাতে তাদের অর্থনীতি আরও পরিবেশবান্ধব করার উদ্যোগ নিতে পারে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায় সে জন্য তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি এসেছে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে।
তবে ধনী দেশগুলোর অর্থ সহায়তার এই প্রতিশ্রুতি খুশি করতে পারেনি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। তারা বলছে, এই অর্থসহায়তা আগের ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি হলেও তা প্রত্যাশিত সহায়তার চেয়ে বেশ কম।
খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও অতিমাত্রায় উষ্ণতা মোকাবেলায় সবমিলিয়ে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল উন্নয়নশীল দেশগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের ব্যাপকহারে স্থানচ্যুতির কারণে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি এসেছে, তা কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি নিয়ে জাতিসংঘের ২০২৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন মতে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ আবহাওয়া-সম্পর্কিত দুর্যোগের কারণে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৬৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এদের মধ্যে অনেকে বন্যা, ঝড়, খরা এবং দাবানলের কারণে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। যার ফলে এক বছরে কমপক্ষে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আরও ১১ লাখ মানুষের স্থানচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো অবশ্য সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যেমন- ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির লাভার উদগীরণ।
নরওয়ের শরণার্থী কাউন্সিলের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রধান জুলিয়া গ্যাসিয়েন আল জাজিরাকে বলেন, “সামনের দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন আরও অনেক বেশি মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটাবে এবং আরও বড় বিপর্যয়কর ঘটনা তৈরি করবে।”
জলবায়ু পরিবর্তন কোথায় সবচেয়ে বেশি স্থানচ্যুতি ঘটিয়েছে
২০২৩ সালে আবহাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি স্থানচ্যুতি ঘটেছে চীন (৪৬ লাখ) ও ফিলিপাইনে (২১ লাখ)। মৌসুমের অন্যতম শক্তিশালী ঝড় টাইফুন ডকসুরির তাণ্ডবে দেশ দুটিতে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং বহু মানুষ প্রাণ হারায়।
গত বছর আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্থানচ্যুতি ঘটে সোমালিয়ায়। সেখানে মোট ২০ লাখ মানুষ স্থানচ্যুত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখেছে সোমালিয়া, যা লাখ লাখ মানুষকে তাদের বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ফেডারেশনের অভিবাসন ও স্থানচ্যুতি বিষয়ক বৈশ্বিক ব্যবস্থাপক ইজেকিয়েল সিম্পেরিংহ্যাম বলেন, “চরম আবহাওয়ার ঘটনা আগে থেকেই সংঘর্ষসহ বিভিন্ন ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য বিপদ আরও বাড়ায়।”
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “এই সমষ্টিগত প্রভাবগুলো মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য এবং জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তোলে।” ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীগুলো প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
গত বছর বন্যা ও ঝড় ছিল প্রধান স্থানচ্যুতির কারণ। এই দুই কারণে যথাক্রমে ৯৮ লাখ ও ৯৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তার পরেই রয়েছে খরা (৪ লাখ ৯১ হাজার) ও দাবানল (৪ লাখ ৩৫ হাজার)।
এ ছাড়া ভূমিধসে অন্তত ১ লাখ ১৯ হাজার মানুষ স্থানচ্যুত হয়। আর ভূমি ক্ষয় ও তীব্র তাপমাত্রার কারণে যথাক্রমে ৭ হাজার ও ৪ হাজার ৭০০ মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটে।
চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ায় স্থানচ্যুতিও বাড়ছে
২০০৮ সালে ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে গত ১৬ বছরে চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ার কারণে স্থানচ্যুতির ঘটনাও দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
বিশেষ করে, বন্যার কারণে স্থানচ্যুতির ঘটনা অনেকে বেড়েছে। ২০১৫ সালে ২৭২টি বন্যায় ব্যাপক স্থানচ্যুতির ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ৭১০টিতে পৌঁছায়— যা ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি।
একইভাবে, ঝড়ের ঘটনা, যেমন হারিকেন, সাইক্লোন এবং টাইফুনও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১৫ সালে ১৬৩টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ১৮৬টিতে দাঁড়ায়—যা ৭ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বন্যা ও ঝড় মিলে বিশ্বের সব আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট ঘটনার মোট ৭৭ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের ক্লাইমেট সায়েন্স, অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড সলিউশনস প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর পুষ্কর খারেচা বলেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন “নিশ্চিতভাবে তাপমাত্রা-সংক্রান্ত চরম আবহাওয়া পরিস্থতির অবনতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “এটি ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বন্যা, খরা, ঝড় এবং সমুদ্রের পানির স্তরও বাড়িয়েছে।”
পুষ্কর খারেচা সতর্ক করেন, চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকবে। এমনকি আমরা যদি অলৌকিকভাবে ২১০০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সক্ষম হই তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
এটি পুরোপুরি থেমে যাবে না, কারণ অতীতের যে ক্ষতি হয়েছে তার প্রভাব এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রার অন্যান্য পরিবর্তন এই অবনতি রোধ করতে পারবে না।
বিশ্ব নেতারা নির্ধারণ করেছেন, চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প বিপ্লব যুগের গড় তাপমাত্রার উপরে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এটি পৃথিবীকে গুরুতর জলবায়ু বিপর্যয়ের (যেমন বিরাট তুষারপাত, বিপদজনক তাপমাত্রা, মারাত্মক বন্যা) থেকে রক্ষা করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা।
বিশ্বব্যাপী স্থানচ্যুতি
২০০৮ সাল থেকে চরম আবহাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী ৩৫ কোটি ৯০ লাখ মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ঘটেছে এশিয়া ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। যথাক্রমে, ১০ কোটি ৬০ লাখ এবং ১৭ কোটি ১০ লাখ।
গত ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি দেশে— চীন, ফিলিপাইন, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। বিশ্বের ৬৭ শতাংশ স্থানচ্যুতির ঘটনাই ঘটেছে এসব দেশে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, গত দুই দশকে দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বা প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ কমপক্ষে একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। যেমন, বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়। বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চল প্রতি বছর গড়ে ১৬০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখোমুখি হবে।
মোটের উপর, গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো ২০২৩ সালে তাদের জনসংখ্যার তুলনায় গ্লোবাল নর্থ বা উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোর চেয়ে পাঁচ গুণ (৫.১৩) বেশি স্থানচ্যুতি দেখেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বড় অংশ অন্তর্ভুক্ত।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খারেচা এই ঘটনাকে ‘বিশ্বব্যাপী অবিচারের’ অন্যতম প্রধান উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো জলবায়ু সংকট সৃষ্টিতে সবচেয়ে কম অবদান রাখলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ভবিষ্যতেও তারা এই প্রভাবের বোঝা বহন করতে থাকবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মাত্র ২৩টি শিল্পোন্নত দেশ, প্রধানত পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা, গত ১৭০ বছরে পৃথিবীর উষ্ণায়নে অবদান রাখা সমস্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের ৫০ শতাংশ নিঃসরণ করেছে। কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে এবং শিল্পেও তারাই উন্নত।
খারেচা বলেন, এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে গরম দেশগুলো বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। তাই বৈশ্বিক তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেই এসব অঞ্চলের জলবায়ুতে উত্তরের শীতপ্রধান অঞ্চলের তুলনায় বেশি প্রভাব পড়ে।
তিনি আরও বলেন, “এছাড়া, এই দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রতি সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। কারণ সাধারণত তাদের কাছে সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং/অথবা প্রযুক্তিগত সম্পদ সবচেয়ে কম রয়েছে।”
কপ সদস্যরা কি স্থানচ্যুতি মোকাবেলায় যথেষ্ট কর্মসূচি নিয়েছে
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের নীতিনির্ধারণী উপদেষ্টা অ্যালিস বায়েলাত বলেন, বিপর্যয়ের কারণে স্থানচ্যুতি মোকাবেলা করতে হলে “এটির মূল কারণগুলো, যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্বলতাগুলো এবং এটি যে ক্ষতি ও হানি সৃষ্টি করে, উভয়ই সমাধান করতে হবে।”
বায়েলাত আল জাজিরাকে বলেন, “কপে দেওয়া বর্তমান প্রতিশ্রুতিগুলো অত্যন্ত অপ্রতুল। এসব প্রতিশ্রুতিতে স্থানচ্যুতির প্রকৃত খরচ পুরোপুরি বিবেচনায় রাখা হয়নি।”
গত সপ্তাহে, ২০০রও বেশি সাবেক নেতা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এক চিঠিতে বলেন, জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন জলবায়ু (কপ) সম্মেলন এখন আর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উপযুক্ত নয়। এবং এর একটি মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খারেচাও এমন সম্মেলনের ফলপ্রসূতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, “সময় ধরে কার্বন নির্গমনের যে কোনও গ্রাফ দেখুন। এসব সম্মেলনের পরেও নির্গমন অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
“যতদিন পর্যন্ত চুক্তিগুলো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না হবে, ‘প্রতিশ্রুতিগুলো’ বারবার পরিবর্তিত হতে থাকবে, ততদিন এভাবে চলতেই থাকবে। আর যদি কোনোদিন এগুলো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে এগুলোকে কেউ কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?”
খারেচা একটি ‘বৈশ্বিক কার্বন মূল্যায়ন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান, যার ভিত্তিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে। তবে তা ন্যায্যভাবে হতে হবে— যাতে কম বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উপর অযৌক্তিক উপশমের বোঝা না পড়ে।