ইতিহাস প্রতিদিন ডেস্ক: হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের পরই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। মার্কিন সাময়িকী টাইমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটা জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সাক্ষাৎকারটি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে টাইম।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন; সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন; মানবাধিকার; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে টাইমের ওই প্রতিবেদনে।
ইউনূস জানান, প্রত্যেককে সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিশ্চিত করা হবে এবং যারা হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য দায়ী, তাদের বিচার সম্পন্ন হলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য স্বাগত জানানো হবে।
তিনি বলেন, ‘তারা অন্য যে কারও মতোই নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ভোগ করবে। আমরা তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যেখানে দমন-পীড়ন, হত্যা, মানুষের গুম এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হতো। এটি ছিল একটি ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা’।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে নিয়েও মন্তব্য করেন ইউনূস। তিনি বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) তো ভারতের আশ্রয়ে আছেনই, তবে এর চেয়ে খারাপ হচ্ছে তিনি কথা বলছেন, যা আমাদের জন্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি করছে। তার কণ্ঠস্বর শুনে মানুষও খুব বিরক্ত হয়। তাই এটা আমাদের সমাধান করতে হবে।’
প্রতিবেদনে, সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হবে নাকি সংসদীয় ব্যবস্থা বহাল থাকবে, সংসদ এককক্ষ বিশিষ্ট হবে নাকি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, এসব বিষয় এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া, সংবিধান সংস্কারের বৈধতা নিশ্চিত করতে গণভোটের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় দেশের বর্তমান কোনো রাজনীতিককে সম্পৃক্ত করা হয়নি।
বিএনপির তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। এটি ভালো দিক নয় এবং ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের’ লক্ষণ প্রকাশ করে।
তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা ও রূপরেখা নির্ধারণের আহ্বান জানান। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, নির্বাচনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমাদের রেললাইন ঠিক করতে হবে, যাতে ট্রেন সঠিক পথে চলতে পারে।’
টাইমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নাও হতে পারে। একসময় দলটির ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও বর্তমানে দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের সদস্যরা অভিযোগ করছেন, তারা নির্বিচার নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, তিনি হত্যা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মসমর্পণ করতে সাহস পাচ্ছেন না। হৃদরোগে ভুগছেন এবং জামিন পেতেও অসুবিধা হবে বলে মনে করেন। টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি জানান, ‘আমার পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে, আমার পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। আমি অসুস্থ মানুষ। চার মাস ধরে আমার পরিবারকে দেখিনি।’
শুদ্ধি অভিযান শুধু আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকার সর্বত্র প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গরা, যারা একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সংযোগ নিয়ে গর্ব করতেন, তারা এখন সাবেক আওয়ামী লীগারদের সম্পর্ক এড়িয়ে চলছেন। তারা ভয় পাচ্ছেন যে এই সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের ওপর চড়াও বা স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারেন।
এদিকে, মানবাধিকার সংস্থাগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, হাসিনা-সমর্থক বলে বিবেচিত সাংবাদিকদের প্রেস কার্ড বাতিল করা হয়েছে এবং অন্তত ২৫ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
‘সংবাদমাধ্যম–সংশ্লিষ্টরা প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন,’ বলেন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের অ্যাডভোকেসি ও সহায়তা পরিচালক আন্তোয়ান বার্নার্ড। তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই প্রতিহিংসামূলক প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের আমলে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইউনুস। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন দুর্নীতি মোকাবিলায় তাদের ব্যবস্থাগুলো শেয়ার করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা নতুন সদস্যপদপ্রত্যাশী দেশগুলোর জন্য কার্যকর।
ইউনুস বলেন, ‘যে দেশগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তারা সবাই টাকা ফেরত আনতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা এর আগেও এমন পরিস্থিতিতে সফল হয়েছে।’
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টাইমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সাক্ষাতে দুই নেতার আন্তরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ থাকলেও, আগামী জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক কেমন থাকবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর কিছু বিচ্ছিন্ন হামলা হয়, যা আরও বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। দলটির দাবি, এই হামলাগুলো প্রমাণ করে কট্টর ইসলামপন্থীরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
৩১ অক্টোবর, ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানান। তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই। দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
এ পরিস্থিতিতে মনে করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও প্রভাবশালী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে ট্রাম্পের কাছে তদবির করছে। এদিকে, ডেমোক্র্যাট নেতা হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছে হিলারির পরাজয়ের পর ইউনূস বলেছিলেন, ‘ট্রাম্পের জয় আমাদের এতটা আঘাত দিয়েছে যে আজ সকালে আমার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
তবে, ইউনুস আশাবাদী যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও তিনি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একত্রে কাজ করার উপায় খুঁজে পাবেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী; আমরাও ব্যবসা করি। আমরা কোনও সংকট থেকে মুক্তি পেতে বিনামূল্যে অর্থ চাইছি না; আমরা একজন ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে যদি অস্থিরতা ও অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে, তবে বিপর্যস্ত জনগণ হয়তো হাসিনার শাসনামলকে আরও ইতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করবে। গত এক দশকে বাংলাদেশ ছিল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অর্থনীতি, যেখানে ২০০৬ সালে জিডিপি ছিল ৭১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।
তবে ইউনূস জানেন, মানুষের জীবিকা উন্নত করাই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করার এবং স্বৈরতন্ত্র ফিরে না আসার ব্যবস্থা করার জন্য পর্যপ্ত সময় পাওয়া যাবে। ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারই পুরো বিপ্লবের মূল। তাই আমরা একে বাংলাদেশ ২.০ বলি’।