চালের বাজার চড়ছে কেন

0

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি গুদামগুলোতে চালের মজুত ৮ লাখ মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। এই মজুত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। দুই মাস আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এই মজুত ছিল সাড়ে ১৪ লাখ টন।

সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন চাল থাকলে মজুত নিরাপদ ধরা হয়। সেখানে মজুত আছে তার অর্ধেকের মতো। আর এটাই চালের দাম বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান।

আমন ধানের চাল বাজারে আসবে ডিসেম্বরের শেষের দিকে। সে হিসাবে জানুয়ারির আগে চালের দাম কমার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর।

একই কথা বলছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেছেন, আমন ধান বাজারে এলে চালের দাম কমবে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ও সরবরাহ বাড়াতে ইতোমধ্যে চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমদানি শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিনই আসছে চাল।

দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল। সরকারের জন্যও একটি সংবেদনশীল পণ্য এটি। গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় চালের পেছনে। চালের দাম এমন সময় বাড়ছে, যখন ভোজ্যতেল, চিনি, সবজি, ডিম, মুরগির মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার (২০ নভেম্বর) পর্যন্ত দেশের সরকারি গুদামগুলোয় সব মিলিয়ে ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৯ টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ৮ লাখ ৮ হাজার ৯৭১ টন, গম ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৯৩ টন ও ধান ৩১৪ টন।

তিন মাস আগে ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি গুদামগুলোয় সব মিলিয়ে ২০ লাখ ৬ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৫১৬ টন, গম ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬০ টন ও ধান ১ লাখ ৭ হাজার ৪৩০ টন।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিন খুচরা বাজার দর প্রকাশ করে। সে অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারগুলোতে প্রতিকেজি মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয় ৫৯-৬৫ টাকায়। আর সরু চালের মধ্যে নাজিরশাইল ও মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৬৮-৮০ টাকায়।

টিসিবির হিসাবেই এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।

অবশ্য রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে টিসিবির দামের চেয়ে ৪-৫ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি হতে দেখা গেছে।

শেওড়াপাড়া বাজারের চাল ব্যবসায়ী মেসার্স মুনা টেড্রাসের মালিক আব্দুল হাকিম বলেন, “এক-দেড় মাস ধরেই চালের দাম বাড়তি। ৬০ টাকার কমে কোনও চাল নেই। মাঝারি ও সরু চালের দাম বেশি বাড়ছে।”

খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই আমন ও বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে সরকারের গুদামে খাদ্যের মজুত বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সন্তোষজনক মজুত থাকে।

এরপর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে চাল-আটা বিতরণ ও বিক্রির কারণে এই মজুত কমতে থাকে। কিন্তু এবার আগেই মজুত কমে গেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১৭ কোটি মানুষের ১৫ কোটিও ভাত খায়, তাহলে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টন চাল প্রয়োজন হয়।
গত কয়েক মৌসুম বোরো ও আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় সরকারকে খাদ্য নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, গম আমদানি হলেও গত দুই বছর সরকারি-বেসরকারি কোনও পর্যায়েই চাল আমদানি করতে হয়নি।

খাদ্য কর্মকর্তারা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আপদকালীন সংকট মোকাবেলায় সরকারের ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন চাল মজুত থাকতে হয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল সরকারের বিভিন্ন গুদামে ৩ লাখ ১১ হাজার টন চাল মজুত ছিল, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সরকারের গুদামে এর চেয়ে কম মজুত ছিল ২০০৮ সালের অক্টোবরে, ২ লাখ ৮০ হাজার টন। এর আগের বছরই ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে দেশে চালের উৎপাদন ২০ লাখ টন কম হয়েছিল।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি মজুত কমে যাওয়াই বাজারে চালের দাম বাড়ার প্রধান। এর মধ্যে উদ্বেগজনক খবর হলো সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও দেশের কয়েকটি জেলার বন্যা। এসব কারণে আমনের আবাদ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১০ লাখ টনের বেশি।

আমন চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টন আমন।

দেশে কোনও মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যায় বোরো মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখনই প্রতিকেজি মোটা চালের দাম বেড়ে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

চাল আমদানি শুরু

সরকারি মজুত বাড়াতে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। মূলত চলতি সপ্তাহ থেকে এই আমদানি শুরু হয়েছে। তবে, পুরোটাই আসছে বেসরকারি পর্যায়ে। সরকারি পর্যায়ে এখন কোনও চাল আমদানি হয়নি।

খাদ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০ নভেম্বর (বুধবার) বেসরকারি পর্যায়ে ৬০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে ৮ হাজার ২১০ টন চাল আমদানি হয়েছে।

দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোনও চাল আমদানি করতে হয়নি। আগের অর্থবছরেও (২০২২-২৩) অর্থবছরেও চাল আমদানির প্রয়োজন হয়নি।

চালের মজুত বাড়াতে গত ৬ নভেম্বর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় আমন মৌসুমে ৩৩ টাকা দরে সাড়ে ৩ লাখ টন ধান ও ৪৭ টাকা দরে সাড়ে ৫ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৪৬ টাকা দরে ১ লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে সরকার।

গত ১৭ নভেম্বর থেকে ধান ও সিদ্ধ চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। চলবে ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর আতপ চাল ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হবে।

ওই সভায় চালের মজুত বাড়াতে ৫ লাখ টন চাল আমদানি সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে ২ লাখ টন কেনা হবে সরকারি মাধ্যমে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকসের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, “এখন চালের দাম যেটা বাড়ছে, সেটা মূলত সরকারি মজুদ কমে যাওয়ার কারণে বাড়ছে। কৃষক ও আড়তদার বা ব্যবসায়ীদের কাছেও খুব বেশি চাল মজুত নেই। সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণেই আসলে চালের দাম বাড়ছে।”

দাম কমাতে চাল আমদানি করা হলেও জানুয়ারির আগে চালের দাম কমার কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না কৃষি অর্থনীতিবিদেরা। তিনি মনে করেন, এখন যে চাল আমদানি করা হচ্ছে, তা দেড়-দুই মাসে আগে করা হলে বাজারে এই অস্থরিতা দেখা দিত না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর বলেন, “যে ব্যবসায়ীদের কাছে চাল মজুত আছে, তারা সরকারি মজুত কমে যাওয়ার খবরে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়েই বাজারে চালের দাম বাড়ছে। আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আমন ধানের চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত বাজার চড়াই থাকবে।”

তিনি বলেন, “বন্যায় আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে। আমনেরও ব্যাপক ক্ষতি হবে। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টনের মতো চাল কম উৎপাদন হবে। উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় আমন ধান উঠতে শুরু করেছে। তবে সারা দেশের আমন ধান উঠতে শুরু করবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়; শেষের দিকে চাল বাজারে আসবে। তখন বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করবে। অর্থাৎ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত বাজারে চালের দাম চড়াই থাকবে।”

এখন চাল আমদানি করার কোনও যুক্তি দেখছেন না কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, “এখন যে চাল আমদানি করা হচ্ছে, সেটা দেড়-দুই মাস আগে করা হলে বাজার স্বাভাবিক থাকত; বাড়ত না। কিছু দিন পরে তো আমন ধান উঠবেই। এখন আমদানির দিকে না তাকিয়ে অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান বাড়িয়ে মজুত বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে ৩ টাকা বেশি দাম দিয়ে কিনে মজুত বাড়াতে হবে।

“বর্তমানে বিশ্ববাজারে চালের যে দাম, শুল্ক কমানোর পরও প্রতিকেজি চাল আমদানি করার পর খরচ পড়ছে ৬০ টাকার বেশি। সে কারণেই ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। তাই আমি মনে করি, এখন আমদানি না করে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ বাড়িয়েই চালের মজুত বাড়ানো উচিৎ।”

একই কথা বললেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ বি এম খোরশেদ আলম খান।

তিনি বলেন, “বন্যায় আউশ ও আমনের ফলন কম হবে, এটা আগেই জানা গিয়েছিল। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই দ্রুত চাল আমদানি করে মজুত বাড়ানো উচিৎ ছিল সরকারের। সেটা না করার কারণেই বাজারে এখন চালের দাম বাড়ছে।”

কারসাজি করে কেউ চালের দাম বাড়াচ্ছে কি না– সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোরশেদ।

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “খাদ্য নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার। তাই দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ও সরবরাহ বাড়াতে ইতোমধ্যে চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর প্রভাবও পড়বে দামে।”

ধান-চাল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এবার বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামসহ আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মানুষের দৈনিক গড়ে চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ গ্রাম। যদি দেশের ১৭ কোটি মানুষের ১৫ কোটিও ভাত খায়, তাহলে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টন চাল প্রয়োজন হয়।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.