ওসমান সরদার, জাবি প্রতিনিধি: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) চলছে বিজয় মেলা-২০২৩। মেলা ঘিরে দিনব্যাপী লোকসমাগম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন চত্বরে। তবে মেলা উপলক্ষ্যে দর্শনার্থী ও বেড়াতে আসা বহিরাগতদের চাপে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আয়োজনে টিএসসি সংলগ্ন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে বণার্ঢ্য বিজয় মেলার। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত এ মেলার জন্য মাসখানেক আগে থেকেই প্রচারণা চালায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডেকোরেশনের কাপড়ে ঘেরা তাঁবুতে স্থাপন করা হয় ৪০ টি স্টল। এসব স্টলে শীতের জামাকাপড় থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনা, বাহারি তৈজসপত্র, ফাস্টফুড, মেয়েদের ব্যবহার্য অলঙ্কার সবই বিক্রি হচ্ছে। অনুমোদিত স্টলের বাইরে পথের ধারে বসেছে ভাজাপোড়া ও ভাসমান খাবারের দোকান। এসব দোকানে উন্মুক্ত পরিবেশে মুড়ি-মুড়কি, নিমকি, জিলাপি, আচার ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অমর একুশের পাদদেশে ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন চত্বরে বসানো হয়েছে নাগরদোলা ও চরকি। ক্যাম্পাসের বাইরে সাভার ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানান বয়সী অসংখ্য দর্শনার্থী মেলা পরিদর্শনে আসছে। মেলাকে ঘিরে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, শহীদ মিনার, বটতলা বাজার, ট্রান্সপোর্টসহ বিভিন্ন জয়গায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
বিজয় মেলার এ প্রভাব পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশে। প্রধান ফটক থেকে শুরু করে শহীদ মিনার ও বটতলা পর্যন্ত দলে দলে অগণিত দর্শনার্থী বিশ^বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রধান সড়কগুলোর উভয় পাশে বসানো হয়েছে ভ্রাম্যমান খাবার ও মণিহারি পণ্যের দোকান। দর্শনার্থীদের চাপে নিজ ক্যাম্পাসেই অনাহূত হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। দিবস উপলক্ষ্যে বটতলায় স্বাভাবিকের তুলনায় দশগুণ ছিল লোকসমাগম। এমনকি দুপুরের পর বটতলায় খাবার খেতে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। চলাচলের জন্য রিকশা ও যানবাহনের স্বল্পতা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও টিএসসি, আ.ফ.ম কামাল উদ্দিন হল, কলা ও মানবিকী অনুষদের শৌচাগার ব্যবহার করতেও শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়া চোখে পড়ার মতো তেমন কিছুর দেখা মেলেনি।
জানা গেছে, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড. আলমগীর কবির এর সময়ে টিএসসি সংলগ্ন জলাশয়টি ভরাট করে এ স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। ২০২২ সালে মেলার প্রথম আসরে বহিরাগতদের চাপ এতটা না থাকলেও এবার তা শিক্ষার্থীদের দুভোর্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এমন মেলার আয়োজনে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রমে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব তালুকদার বলেন, ‘এটা কোন বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ হলো? বিজয় দিবসের মতো সুন্দর একটা দিন। উদযাপনের উপায় নেই। হল থেকেই বের হওয়া যাচ্ছে না। এত পরিমাণ দর্শনার্থী ভর্তি পরীক্ষার সময়ও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় তো বহিরাগতদের মেলা করার জায়গা না। এসব মেলা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।’
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোন আয়োজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে শিক্ষার্থীরা। সেখানে শিক্ষনীয় কিছু ইভেন্ট থাকবে, এ আয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যু্ক্ত করবে এটাই হওয়া উচিত। ঢাকা শহরের বাসিন্দারা জাহাঙ্গীরনগরকে একটা আউটিং প্লেস হিসেবে ব্যবহার করছে। দর্শনার্থীদের ক্যাম্পাসে আসতে কোন বাধা নেই। তবে সে সুযোগ এভাবে উন্মুক্ত না রেখে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। উন্নত দেশগুলোতে খাবার ও অন্যান্য দোকানপাটের জন্য ডেডিকেটেড স্পেস বা সিটি সেন্টার থাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু পযার্প্ত জায়গা আছে সেহেতু এটা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অবিলম্বে নোটিশ দিয়ে এসব কাপড়ের দোকান বা ভাসমান খাবারের দোকান তুলে দেয়া প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদে একাডেমিক এরিয়ার বাইরে একটা স্থানকে এজন্যে নির্ধারিত করা দরকার।
এদিকে বিজয় মেলায় স্টল বরাদ্দকে ঘিরে বাড়তি অর্থ আদায় ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুই হাজার পাঁচশত টাকায় প্রতিটি স্টল বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়েছে। মাত্র ৪০ টি স্টল হওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে প্রায় শতাধিক স্টল দেখা গেছে। তাঁবু ঘেরা স্টলের বাইরের ফাঁকা জায়গায় মাটিতে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। এসব দোকানে রশিদ বহির্ভূত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে টিএসসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। টিএসসি সংলগ্ন মুড়ি-মুড়কির দোকানদার রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমি দোকানের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। আমাকে কোন রশিদ দেয়া হয়নি। এখানে কেউ দুই হাজার, কেউ এক হাজার টাকা দিয়েছে।’
তবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে মেলার দায়িত্বে থাকা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পরিমল সরকার বলেন, ‘অনেকে বিকাশে পেমেন্ট করেছে এজন্যে রশিদ দেয়া হয়নি। এক ব্যাক্তি চারটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন, তাই তার কাছ থেকে ৫০০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত স্টলের চেয়ে অতিরিক্ত দোকানের ব্যাপারে তিনি বলেন, বাইরের ভাজাপোড়া বা ছোট টেবিল দিয়ে দোকান বরাদ্দের মধ্যে ছিল না। মুক্তভাবে শিক্ষার্থীরা এসব দোকান দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ীই মেলা একদিন বর্ধিত করা হয়েছে। তবে এই মেলাটা একটা লস প্রজেক্ট৷’
তবে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আয়োজনে এ মেলা আয়োজিত হওয়ায় দায়িত্ব নিতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস। ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবদুর রহমান বাবুল বলেন, ‘টিএসসির সামনে দোকানের বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি টিএসসি থেকে দেয়া হয়েছে। এখানে এস্টেট অফিসের কিছু করার নেই। সাধারণভাবে সড়ক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব। তবে বিজয় মেলা উপলক্ষ্যে যে বাড়তি ময়লা-আবর্জনা তা টিএসসি পরিষ্কার করবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি মাইকিং করে বাইরে থেকে লোকজন নিয়ে আসে, তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এত লোক সামাল দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। নিরাপত্তা অফিস থেকে একজনকে দেয়া হয়েছে। তার পক্ষে এতো লোকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না। এখানে যদি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে এর দায় আমরা নিতে পারব না, প্রশাসনকে নিতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ.স.ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘বিজয় দিবসে বিশেষ দিন বিধায় স্মৃতিসৌধকে কেন্দ্র করে অনেকেই ক্যাম্পাসে এসেছে, মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান, মেলাও হচ্ছে যার কারণে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এত মানুষের সমাগম হওয়ার কারণে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, তারপরও আমরা চেষ্টা করছি যেন কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে। তবে মেলার আয়োজন ও সময়সীমার ব্যাপারে আমি টিএসসি পরিচালকের সাথে কথা বলব।
মেলার আয়োজনের ব্যাপারে কথা বলতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আহমেদ রেজাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। তবে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি আপাতত বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত আছি। আগামীকাল অফিসে আসলে সরাসরি কথা বলব।’ তবে পরদিন সারাদিনে বহুবার অফিসে গিয়েও তার দেখা পাওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, ‘গতকাল বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে উপচে পড়া ভিড় ছিল। তবে একদিনে যেন না বাড়ে সে ব্যাপারে আজ কথা বলব। সবার সহযোগিতা পেলে এ অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে।’