আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে শান্তি আলোচনার কথা বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপ এনিয়ে খুশি ছিল। তারা আর যুদ্ধ চাইছিল না।
অবশ্য ট্রাম্পের শান্তি চুক্তির প্রস্তাবে ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি হলে তা রাশিয়াবান্ধব হবে। চুক্তিতে ইউক্রেনের স্বার্থের প্রতিফলন সেভাবে থাকবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সম্ভাব্য শান্তি আলোচনা নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যস্ত, সেসময় যুদ্ধের দামামা হঠাৎ নতুন মাত্রায় আরও তীব্রতা নিয়ে বেজে উঠল।
গত মঙ্গলবার ও বুধবার রাশিয়ার ভূ-খণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তৈরি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইউক্রেন। জবাবে গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের দিনিপ্রো শহরে নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে রাশিয়া। তার আগে অবশ্য কয়েকবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এর মধ্য দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে রাতারাতি পাল্টে যায় ২০২২ সাল থেকে চলতে থাকা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
রাশিয়ার ভূ-খণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে গত রবিবার ইউক্রেনকে অনুমতি দিয়েছিল হোয়াইট হাউস। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই পার্শ্ববর্তী দেশে হামলা চালাতে দেরি করেননি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ইউক্রেনের হামলার জবাবে মস্কো যে নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে দেশটির দিকে তাক করে, সেটি ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছিল বলে দাবি করেছেন পুতিন। মধ্যপাল্লার এই হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে সক্ষম বলে দাবি তার।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন যে পেরে উঠছে না, বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে টেনে তোলার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন।
সিএনএনের প্রধান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্পাদক নিক প্যাটন ওয়ালশ মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তা হয়তো হবে না। তবে তারা রাশিয়া-ইউক্রেনের ক্রমাগত বৈশ্বিক হয়ে ওঠা যুদ্ধে নিজেদের আরও বেশি করে জড়াবে।
গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার ছোড়া নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ওরেশনিক নিয়ে এ মুহূর্তে উত্তপ্ত বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গন। এটি ঠিক কী ধরনের অস্ত্র, তা নিয়ে ধোয়াশা আছে।
ওরেশনিক সম্পর্কে পুতিন কেবল বলেছেন, সেকেন্ডে এটি তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম, যার অর্থ এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিপরীতে পশ্চিমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনও কাজে আসবে না।
রুশ এই ক্ষেপণাস্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কর্মকর্তারা শুরুতে ‘পরীক্ষামূলক’ ও কেবল ‘মধ্যপাল্লার’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। যদিও পরে সে অবস্থান থেকে সরে আসেন তারা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নেতারা এখন জানেন, ওরেশনিক পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম।
সিএনএনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্পাদক ওয়ালশের ধারণা, ওরেশনিকের মতো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ছুড়ে ক্রেমলিন হয়তো ওয়াশিংটন বিশেষ করে ট্রাম্পকে বিশেষ কোনও বার্তা দিতে চেয়েছেন।
২০১৯ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে রাশিয়ার সঙ্গে এ ধরনের মারণাস্ত্র বিকাশের কার্যক্রম সীমিত করার চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন ট্রাম্প। এর কারণ হিসেবে তিনি সেসময় অভিযোগ করে বলেছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি নামের ওই চুক্তি মানছে না ক্রেমলিন।
পাঁচ বছর পর ওরেশনিকের মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ক্রেমলিন হয়তো ওয়াশিংটন তথা ট্রাম্পকে জানাল, তারা আসলেই এ ধরনের অস্ত্র উন্নত করার কার্যক্রম বন্ধ করেনি।
নিক প্যাটন ওয়ালশ বলেন, ওরেশনিক কোনও একক বার্তা দিচ্ছে না কি এটি নতুন কোনও কৌশল, তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অস্থির।
তারা এই বক্তব্য দিয়েছে কারণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেসব খবর আসছে, তা ইউক্রেনের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। দেশটিকে সব দিক দিয়ে চাপে ফেলেছে মস্কো।
কুরস্ক অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সরাতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনারা। তাদের আক্রমণে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে ইউক্রেন।
খারকিভের দক্ষিণেও অগ্রসর হচ্ছে রুশ সেনারা। পূর্ব দনবাস অঞ্চলের চারদিকে ইউক্রেনের সেনাদের জন্য খাবার ও অস্ত্র সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। জাপোরিঝিয়ার দক্ষিণাঞ্চলেও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে চাপে রেখেছে রুশ সেনারা।
বাইডেন প্রশাসন হয়তো ইউক্রেনে আরও অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠানোর অঙ্গীকার করবে। কিন্তু গত এক সপ্তাহে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
এ অবস্থায় যুদ্ধ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে, নাকি ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ যুদ্ধে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।