‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মানবিক বাণী। সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, যখন রক্ত ঝরছে পৃথিবীর নরম শরীর থেকে, তখন এই বাংলার এক কবি বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন মানবতার অমর কবিতা।
একইভাবে বিশ্বের সকল ধর্মেই মানবতার দর্শন নিহিত রয়েছে। যুগে যুগে ধর্ম প্রবর্তকগণ সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। স্রষ্টাকে ভালোবাসতে হলে প্রথমে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। ধর্মের মূলেই রয়েছে প্রেম। কারণ যিনি সৃষ্টিজগতের মালিক, তিনি প্রেমের কারণেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন।
বৌদ্ধধর্ম মতে, কারো সাথে এমনভাবে আচরণ করো না, যা তোমার নিজের কাছে বেদনাদায়ক মনে হতে পারে। যে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে পেরেছে, শান্তি এবং সত্যকে লাভ করেছে, সেই সুখী। তোমার দুঃখের কারণ যাই হোক না কেন, অপরকে আঘাত করো না। অপরের প্রতি শুভেচ্ছা প্রকাশই ধর্ম। সর্বপ্রাণীর প্রতি অন্তরে অসীম মৈত্রী পোষণ করো। সকলেই সুখ চায়, অতএব, সকলের প্রতি করুণা প্রদর্শন করো। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা মহামানব গৌতম বুদ্ধের প্রতিটি বাণীই ছিল অহিংস ও সাম্যনীতির পক্ষে। তার ধর্মে কোনো অলৌকিকত্ব নেই, নেই কোনো ঈশ্বরস্তুতি কিংবা ভক্তিবাদ। আছে শুধু বুদ্ধি ও বিবেকশানিত যুক্তি ও আত্মজিজ্ঞাসা। আছে নিজকে দেখার, জানার ও বিচার করার পরম শিক্ষা। এটাই বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন। বৌদ্ধধর্মে কোনো ধরনের জাতি-বর্ণভেদ নেই, নেই কোনো ধরনের শ্রেণীবৈষম্যও। মানুষ হিসেবে তিনি সবাইকে দেখেছেন একই দৃষ্টিতে, সমজ্ঞানে। তাই বুদ্ধবাণীতে বারবার ধ্বনিত হয়েছে অহিংস, শান্তি ও বিশ্বপ্রেমের কথা। উচ্চারিত হয়েছে মহাসাম্য ও মহামৈত্রীর কথা।
ইসলাম ধর্মে মানবতাকে রাখা হয়েছে সবার উপরে। বলা হয়েছে, মানবের সেবা মানেই সৃষ্টিকর্তার সেবা। তুমি যদি সৃষ্টজীবকে ভালোবাস, তাহলে ঊর্ধ্বলোকের মহান স্রষ্টা তোমাকে ভালোবাসবেন। সকল সৃষ্টজীবকে সৃষ্টিকর্তা একই পরিবারভুক্ত মনে করবে। তাঁর সৃষ্টজীবকে যে ভালোবাসে সেই তাঁর প্রিয়। ইসলাম ধর্মের মহামানব মহানবী (সা.) বলেছেন-যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব। মহানবী (সা) আরো বলেছেন-মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে মানুষের উপকার করে।
হিন্দুধর্ম মতে, কারো সাথে এমন কিছুই করো না, যা তোমার সাথে করা হলে তুমি দুঃখ পেতে। এই হচ্ছে দায়িত্ব সমষ্টি। এছাড়া হিন্দু ধর্মের অসংখ্য মহামানব মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে হাজারো বাণী দিয়ে গেছেন। হিন্দু ধর্মের মহামানব স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর, আরেক মহামানব শ্রী শ্রী ঠাকুর অনকুলচন্দ্র বলেছেন-মানুষ আপন টাকা পর, যতো পারিস মানুষ ধর। এসব অমর বাণী কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য তারা বলেনি। বলেছে সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে।
এদিকে খ্রিষ্টধর্ম মতে, সবকিছুর মধ্যে অপরের কাছ থেকে তোমরা যে ব্যবহার প্রত্যাশা করো, তাদের প্রতিও তেমনি ব্যবহার করো; কারণ এটাই বিধান এবং নবিগণের শিক্ষা। সূর্য যেমন সব জায়গাতেই কিরণ দেয়, বৃষ্টিধারা যেমন সবকিছুতেই সিঞ্চিত করে, তুমিও তেমনই ভেদাভেদ না করে সবাইকে সমান ভালোবাসবে। পৃথীবিতে এমন হাজারো ধর্ম রয়েছে। যার প্রতিটিই মানবতার মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে বিশ্বাস করে, মানবতার কথা বলে। আর যে ধর্মে মানবতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে সেটি কোনো ধর্ম হতে পারে না।
২
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান সব ধর্মেই মানবিকতা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ সিনেমাটি মানবতার উদাহরণ হতে পারে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হয়েও নাৎসি পার্টির সমর্থক অস্কার শিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী কীভাবে সহস্রাধিক ইহুদির জীবন বাঁচিয়েছিলেন। অন্য ধর্মের হয়ে তিনি ইহুদিদের গ্যাস চেম্বার থেকে বাঁচাতে গেলেন কেন? এ বিষয়ে শিন্ডলার তার এক ইহুদি বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, জার্মানরা ভুল করছে। নিরীহ মানুষকে ওভাবে বিনা কারণে কোতল করা যায় না। ওই নৃশংসতা থেকে লোককে বাঁচাতে আমার যেটুকু করা উচিত ছিল, সেটাই করেছি। এর বেশি কিছু নয়। দ্যাটস অল, নাথিং মোর টু ইট।
অতএব আপনি যদি ধার্মিক হতে চান-তবে আগে মানুষকে ভালোবাসুন। এটাই প্রকৃত ধর্ম। আর এটাই চিরসত্য। এটাই মানবতাধর্ম। মানুষ আর মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
লেখক: মো. আনিসুর রহমান, উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ কর্ম কমিশন সচিবালয়।