সুজনের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
আগামী নির্বাচনের উপর শুধু গণতন্ত্রই নয়, দেশের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে
স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে তার উপর শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্রই নয়, গোটা দেশের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। পাগল ছাড়া কেউই বিশ্বাস করে না যে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। মঙ্গলবার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে “প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, সাংবিধানিক কাঠামো ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ” শীষর্ক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে লিখিত প্রবন্ধ পড়ে শোনান সংগঠনটির স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক তথা গ্রহণযোগ্য করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলা জরুরি। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যা থাকতে পারে তা হলো: নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অলৌকিক কিছু না ঘটলে কিংবা ‘অন্যকিছু’ না হলে সরকার সংবিধান সংশোধন করবে না। এখন পর্যন্ত আমার মনে হচ্ছে নির্বাচন এই পদ্ধতিতেই হবে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যে যাই বলুন, বাংলাদেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কোনো একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে দুটি দলই অংশগ্রহণ করে। আর এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যদি ভূমিকা না নেন, তাহলে এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আমার মনে হয় না। যদি অংশগ্রহণমূলক হয়েও থাকে, তবে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটাও আলোচনার বিষয়।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যাদের দিয়ে নির্বাচন করাবে তারা বিগত ১৫ বছরে পলিটিসাইজ হয়েছে। কিছুদিন আগে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র অনুষ্ঠানে একটি মেয়ের উপরে ইউএনও যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতেই বোঝা যায় তাদের মেন্টালিটি এখন কোন অবস্থায় আছে। এছাড়া ডিসিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন যে বৈঠক করেছিল সেখানে ডিসিরা কমিশনের কথাকে প্রটেস্ট করেছে। এই ধরণের ঘটনা কখনো ঘটেনি। এখন আমি চিন্তা করি এই নির্বাচন কমিশন তাদেরকে দিয়ে কিভাবে নির্বাচন করবে। নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে যেগুলো আসলে প্রয়োজন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, মূল দরকার হলো আইনের প্রয়োগ। গাইবান্ধা নির্বাচনে এতো বড় একটা তদন্ত করা হলো, ৮৮ জন মানুষকে দোষী করা হলো, কিন্তু তাদের একজনের বিরুদ্ধেও ইসি একশন নেয়নি। যদিও আরপিওতে নির্বাচন কমিশনকে এই ধরণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, মূল সংকটটা হলো রাজনৈতিক, সাংবিধানিক সংকট না-অংশগ্রহণমূলক বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না তার সংকট। রাজনীতিকে এককেন্দ্রিক করার প্রবণতা। যেভাবেই হোক পুনঃ পুনঃ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। কার্যত অগণতান্ত্রিক দৃশ্যত গণতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থা টিকিয়া রাখা হচ্ছে, যেখানে দল থাকবে কিন্তু গণতন্ত্র থাকবে না। অর্থাৎ দলীয় একটি আবহ থাকবে কিন্তু বহদলীয় গণতন্ত্র থাকবে না। আগামীতে তিনটা পথ আমাদের সামনে আছে: যা আছে তাই থাকবে, যার পরিণতি হবে কম্বোডিয়ার মতো। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। তিন নম্বর পথ হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না এনে করতে চাইলে একটা ছোট ক্যাবিনেট করা যায়, যেখানে ৯০ শতাংশ নির্বাচিত ১০ শতাংশ অনির্বাচিত এবং তারা নির্বাচন করবেন না। প্রেসিডেন্ট ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন।
অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আইন কর্মকর্তা ড. রিদওয়ানুল হক বলেন, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলা যায় না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দলের নামমাত্র অংশগ্রহণ ছিল। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে এবং প্রশাসনের সকল স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের মাধ্যমে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা আছে।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১ অনুচ্ছেদের পরের অংশটি বাদ দেয়া হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে কয়েকটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের পর পঞ্চদশ সংশোধনীয় মাধ্যমে সেটি বাদ দেয়া হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের উপায়। গণতন্ত্রের প্রয়োজনে, মানুষের স্বার্থে নির্দলীয় সরকারের অধীনের নির্বাচন দিলে তা সাংবিধানিক হবে।
সুজন সহ-সভাপতি বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, বর্তমান সংকটটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক উভয়েই। অনেক সংকটের মূলে আছে রাজনীতি, কিন্তু সমাধান করতে হবে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আগামী নির্বাচনের উপর শুধুমাত্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র না, গোটা দেশের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আমরা দেখেছি জনগণের ভোটাধিকার লুন্ঠিত করে এই সরকার কিভাবে আদানির সাথে বিদ্যুৎ চুক্তি করেছে, রামপাল চুক্তি করেছে। এই সরকারের অধীনে যে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এটার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচন দেখলেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে পুলিশ কর্মকর্তাদের সরসরি বক্তব্য দিতে শুনি।
কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচন দেখেছি। আমি বলতে চাই, পাগল ছাড়া কেউই বিশ্বাস করে না যে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য স্বরাষ্ট্র, তথ্য আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর অধীনে দিতে হবে, কালাকানুন বাতিল করতে হবে, পর্যবেক্ষকদের সুযোগ করে দিতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, মানুষ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ভোটকেন্দ্রে আসছেন না। প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করলে ভোটে একটি ভারসাম্য আসতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চর্চা না হলে জবাবদিহিতার অভাবে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সংকট তৈরি হয়। এখন সবকিছু ব্যুরোক্রেসির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কারণ, নির্বাচনে জিততে হলে ব্যুরোক্রেসি লাগবে। দুর্নীতি একদম তৃণমূলে চলে গেছে।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচন নিয়ে যতো কথাই বলি ঘুরেফিরে ওই একটি কথাই আসে- নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার চাই, যেটা আগে ছিল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল নিয়ে অতীতে কোনো বিতর্ক হয়নি। এ বিষয়ে সমঝোতায় না আসতে পারলে দেশের জন্য সামনে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।